ঢাকা,শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

নাগরিকত্ব ও ভিটে-বাড়ির নিশ্চয়তা পেলে মিয়ানমার ফিরবো

কক্সবাজার প্রতিনিধি :: ‘অতিথি হিসেবে কোন বাড়িতে দীর্ঘদিন থাকা যায় না। নিজ দেশে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়ে ক্ষতবিক্ষত শরীরে বাংলাদেশে আশ্রয় পেয়েছি। জাতিসংঘের সহযোগিতা ও বাংলাদেশের আন্তরিকতায় শরীরের ক্ষত শুকিয়েছে, কিন্তু পূর্ণ নাগরিকত্ব দিয়ে মিয়ানমার আমাদের ফিরিয়ে না নেয়া পর্যন্ত মনের ক্ষত শুকাবে না। রোহিঙ্গা হিসেবে নাগরিকত্ব ও ভিটে-বাড়ির নিশ্চয়তা পেলে আমরা যেকোন সময় মিয়ানমার ফিরে যাবো। বাংলাদেশে আমরা ভালো আছি, তাই বলে এখানে থেকে যেতে চাই না।’
বৃহস্পতিবার (২৫ আগস্ট) সকালে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন ও সমাবেশে এসব কথা বলেছেন রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতারা। নিজ দেশ মিয়ানমারে ২০১৭ সালের এ দিনে (২৫ আগস্ট) রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণসহ নিপীড়নে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পঞ্চম বর্ষ অতিক্রমের দিনে গণহত্যার বিচার ও সম্মানজনক ভাবে ঘরে ফেরার দাবিতে এ মানববন্ধন ও সমাবেশ করে রোহিঙ্গারা।পরে মিছিল করে ।
১৩ নাম্বার ক্যাম্পের তাজনিমার খোলা খেলার মাঠে আয়োজিত মানববন্ধন উত্তর সমাবেশে বি ব্লকের হেডমাঝি মো. ইব্রাহিম, হেড মাঝি মুহাম্মদ আলী ও রোহিঙ্গা নেতা মোজাম্মেল হকসহ অন্যরা বক্তব্য রাখেন।

চরম বর্বরতায় গণহত্যার বিচার দাবি ও পূর্ণ নাগরিক অধিকার দিয়ে মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন দাবিতে উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের তাজনিমারখোলার ১৩ নং রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও সুলিমুল্লাহ কাটা এলাকায় ১৬ নং ক্যাম্পের মতো কুতুপালং লম্বাশিয়া, বালুখালী পানবাজার ক্যাম্পসহ ২০টি ক্যাম্পে শান্তিপূর্ণ এ মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে রোহিঙ্গারা।
বৃহস্পতিবার (২৫ আগস্ট) বেলা সোয়া ১০টা হতে পৃথকভাবে শুরু হওয়া মানববন্ধন ও সমাবেশ চলে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত। তীব্র গরম উপেক্ষা করে ‘গো ব্যাক হোম- প্রতিপাদ্যে চলমান মানববন্ধনে নানা দাবি নিয়ে বক্তব্য রাখেন ক্যাম্প ও ব্লক ভিত্তিক কমিউনিটি রোহিঙ্গা নেতারা। এসময় উপস্থিত রোহিঙ্গারা একবাক্যে দাবি করে- ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’।
কথা ছিল সমাবেশ নয়, শ’খানেক রোহিঙ্গারা মানববন্ধন করতে পারবে। কিন্তু নিপীড়নের বিচার দাবিতে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মানববন্ধনে জড়ো হয়ে যান হাজারো রোহিঙ্গা। এতে মানববন্ধনগুলো সমাবেশে রূপ নেয়। এখানে তারা ২০১৭ সালে তাদের উপর ঘটে যাওয়া হত্যা, ধর্ষণসহ নিপীড়নের সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন। পূর্ণ মর্যাদা নিয়ে প্রত্যাবাসন কামনা করেন তারা। এসময় তাদের নিরাপদ আশ্রয় দেয়ায় বাংলাদেশ সরকার ও প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতারা স্বগোত্রীয়দের উদ্দেশ্যে বলেন, আমাদের আশ্রয় দিয়েছে বলে এদেশের সরকার ও জনগণের মনখারাপ হয় এমন কোন কাজ করা থেকে বিরত থাকুন। আমাদের অনেকে মাদকসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডে যুক্ত হয়ে পুরো আশ্রিত রোহিঙ্গা কওমকে লজ্জায় ফেলেছেন। প্রত্যাবাসন হতে কতদিন, কতবছর লাগে তা সঠিক হিসাব নেই। ততদিন যেন বাংলাদেশ সরকার ও স্থানীয় জনগণ আমাদের সুন্দর মনে আশ্রয় দেন, সেই পরিস্থিতি বজায় রাখুন।
তাজনিমার খোলার বয়োবৃদ্ধ রোহিঙ্গা আমেনা খাতুন বলেন, আমরা মিয়ানমারের অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছি। নারীদের ধর্ষণ, শিশুদের হত্যা করে আগুনে নিক্ষেপ, গর্ভবতীর পেট কেটে মা-বাচ্চা দুজনকেই হত্যা। এত বর্বরতার শিকার যেন পৃথিবীর আর কেউ না হন। এদেশে থাকতে পারবো না জানি, এরপরও মর্যাদা না পেলে বার্মায় (মিয়ানমার) ফিরতে মন চাই না।বিশ্বনেতাদের প্রতি অনুরোধ, আমাদের নাগরিকত্বসহ সম্মানজনক প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করুন।
রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তায় দায়িত্বরত ৮ এপিবিএন’র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. কামরান হোসেন বলেন, ৮ এপিবিএনের আওতাধীন ১৩ ও ১৬ নম্বর ক্যাম্পসহ আশপাশের ২০টি ক্যাম্পের পৃথক স্থানে রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফেরার আকুতি জানিয়ে শান্তিপূর্ণ ভাবে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে। সকাল ৯টা হতে নির্দিষ্ট জায়গায় জড়ো হতে থাকে রোহিঙ্গারা। সোয়া ১০টার দিকে তারা ব্যানার ও পেস্টুন নিয়ে মানববন্ধনে দাঁড়িয়ে যান। তেমন কোন প্রচারনা না থাকলেও ধীরে ধীরে রোহিঙ্গা সমাগম বেড়ে সমাবেশে পরিণত হয় মানববন্ধন। সেখানে বক্তব্য দিতে গিয়ে পুরোনো স্মৃতি উল্লেখ কালে রোহিঙ্গা কান্নায় ভেঙে পড়েন। সবার একবাক্যে দাবি গণহত্যার বিচার ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসন। রোহিঙ্গা সংকটের ৫ বছর উপলক্ষে সকল ক্যাম্পে নিত্যদিনের চেয়ে নিরাপত্তা জোরদার ছিল। এপিবিএনের পাশাপাশি শৃংখলা বাহিনীর অন্য বিভাগও সতর্কাবস্থায় দায়িত্ব পালন করেছে।
সমাবেশ ও মানববন্ধন শেষে প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে আল্লাহর রহমত কামনা করে ক্যাম্পে ক্যাম্পে দোয়া ও মিলাদ পড়ানো হয় বলে জানিয়েছেন কুতুপালং ক্যাম্প এলাকার জনপ্রতিনিধি প্রকৌশলী হেলাল উদ্দিন।
এদিকে, দেশে রোহিঙ্গা ঢলের ৫ বছর পূর্তির দিনে তাদের দ্রুত প্রত্যাবাসন দাবিতে মানববন্ধন করেছে রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি কক্সবাজার। বৃহস্পতিবার (২৫ আগস্ট) সকালে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মাহবুবুর রহমানের সভাপতিত্বে ও প্রচার সম্পাদক নেজাম উদ্দিনের সঞ্চালনায় মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন, কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক বিষযক সম্পাদক অ্যাডভোকেট তাপস রক্ষিত, কক্সবাজার খেলাঘর আসরের সভাপতি আবুল কাসেম বাবু, কক্সবাজার সোসাইটি সভাপতি গিয়াস উদ্দিন প্রমূখ।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের ৫বছর পূর্ণ হয়েছে। অথচ এখনো তাদের প্রত্যাবাসনের কোন প্রক্রিয়া দৃশ্যমান নয়। কয়েকবার তাদের প্রত্যাবাসনের কথা আসলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে রোহিঙ্গাদের কারণে মাদকের আগ্রাসন, চুরি ডাকাতিসহ সমাজে অপরাধ বেড়েছে। রোহিঙ্গার কারণে স্থানীয় নাগরিকদের রোহিঙ্গা নয় মর্মে প্রত্যয়ন নিতে হয়। এটা আমাদের জন্য লজ্জাজনক। কক্সবাজারবাসি আজ অতিষ্ঠ। এ থেকে মুক্তির একমাত্র পথ প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে কক্সবাজারকে রোহিঙ্গামুক্ত করা।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নির্যাতন ও গণহত্যার শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা দেশ ছাড়া হবার ৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে সমাবেশ ও মানববন্ধনের আয়োজন করে বৃহস্পতিবার।
এর আগে, ২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট ক্যাম্পে প্রথম বড় সমাবেশ করা হয়, যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মাস্টার মুহিবুল্লাহ। পরে তিনি স্বগোত্রীয় সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হন। এবারের সমাবেশে কেউ নেতৃত্বে ছিলেন না। কমিউনিটি নেতারাই রোহিঙ্গাদের জড়ো করান।

পাঠকের মতামত: